আলওয়ার সাধকদের উৎপত্তি তামিলনাড়ু–কেরালা অঞ্চলে। আলওয়ার দলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের ১২ জন সাধক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই ১২ জনের মধ্যে আণ্ডাল ছিলেন একমাত্র মহিলা সাধিকা। ‘আলওয়ার’ শব্দের অর্থ হল ‘সম্পূর্ণভাবে নিমগ্ন থাকা’। বিষ্ণু এবং কৃষ্ণের প্রতি ওনাদের হৃদয়স্পর্শী প্রার্থনা পরবর্তীকালে সারা ভারতের বহু ভক্ত কবির রচনাকে অনুপ্রাণিত করে। ,
উদাহরণ স্বরূপ: “আমার আত্মা যন্ত্রণায় নিঃশেষ হয়ে যায়, সে তোয়াক্কা করে না আমি বাঁচি না মরি” – আণ্ডাল।
“(কৃষ্ণের গায়ের রঙের মত) ঘন কালো আঁধার নেমে এল, তবু কৃষ্ণ এল না” – নাম্মাজভার।

www.ramanuja.org. থেকে আন্ডালের ছবিটি নেয়া হয়েছে।

লিঙ্গায়েতরা বীরশৈব (বীর শিব ভক্তগণ) সাধুদের অনুগামী। তাঁরা বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির সব ধরনের বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেন। আক্কা মহাদেবী আত্ম – নির্বাণ পাওয়ার জন্য বিবাহ ও সমাজকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রখ্যাত বীরশৈব সভা ‘অনুভব মণ্টপ’ (অর্থাৎ অভিজ্ঞতার সভা)- এ সাধু আল্লমা-র সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের সংলাপগুলিই তাঁর বচন (ভক্তি কবিতা)-রূপে পরিচিত। আক্কা মহাদেবী সম্পূর্ণরূপে পোশাক ত্যাগ করে, নিজের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা লম্বা চুলের জটায় শরীর ঢেকে রাখতেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে শিবই তাঁর স্বামী।

উইকিমিডিয়ার ছবিতে যে মূর্তি দেখছেন, সেটি সেটি আক্কা মহাদেবীর জন্মস্থান উদটাডি, শিমোগা, কর্ণাটকে স্থাপন করা তাঁরই একটি মূর্তির ছবি।

লাল দেদ নিজেকে শৈব যোগিনী বলে পরিচয় দিতেন। তাঁর কথায় – “ও নীলকণ্ঠ, আপনার মধ্যেও যেমন ছয়টি তত্ত্ব, আমার মধ্যেও ঠিক সেরকম। তা সত্ত্বেও আপনার থেকে আমি আলাদা, সে কারণে অতি অভাগী”। তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘বাখ’ থেকে জানা যায় যে তিনি তাঁর পিতার কাছে শিক্ষালাভ করেন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু সেই বিবাহ সুখের হয় নি। অসুখী দাম্পত্যের কারণে তিনি বাড়ি ছেড়ে যাযাবর তপশ্বিনী হয়ে যান। তাঁর বাণী শুনতে ও বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত। সকলেই তাঁকে আপন করে নিয়েছিল — এমনকি এক মুসলিম লেখক লিখেছেন যে উনি (লাল দেদ) প্রাচীন হিব্রু নবীদের মতো আত্মহারা হয়ে নাচতেন।

লাল দেদের এই ছবিটি historified.in থেকে নেওয়া। এতে কাশ্মীরি মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী চুল বাঁধার স্কার্ফ ও বেণী চোখে পড়ে।

শ্রীকালহস্তীশ্বর হলেন শিব, যাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তিনটি প্রাণী—শ্রী (মাকড়সা), কালা (সাপ), ও হস্তি (হাতি)—যাদের নিয়ে স্থানীয় শিবকথা প্রচলিত আছে। দক্ষিণ ভারতে পাঁচটি মন্দির প্রকৃতির পঞ্চতত্ত্বের উদ্দেশ্যে সমর্পিত। এই পঞ্চতত্ত্বের একটি তত্ত্ব হল – বায়ু। শ্রীকালহস্তি মন্দির এই বায়ু তত্ত্বের প্রতীক। ‘ধূর্জটি’ নামটির অর্থই হলো “জটাজুটধারী” – সম্ভবত তিনি ছিলেন এক শৈব ত্যাগী, যাঁর জটাজুট ছিল গোমূত্র-গোবরে মাখা। এ ধরনের সন্ন্যাসীরা জাত ও কুল মানেন না এবং নিজেদের শিবের বংশধর বলে মনে করেন। ধুর্জটির কবিতা চোস্ত তেলুগু ভাষায় লেখা। এগুলি রাজ দরবারে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু তাঁর কবিতার গভীরে লুকিয়ে রয়েছে প্রবল ভক্তি ও সংসারের প্রতি গভীর বিতৃষ্ণা। ওনার ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না, কিন্তু কবি নিজের যৌবনের কিছু কৃতকর্মের প্রতি যথেষ্ট বিরক্ত। উনি লিখেছেন, “কামনার ডামাডোলে যুবাবয়স হারিয়ে গেছে। এই সংসারের পাকেচক্রে আর ঘুরতে চাই না। হে কালহস্তির ঈশ্বর, আমায় আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি দাও।”

শ্রীকালহস্তি মন্দিরের এই সুন্দর ছবিটি Flickr থেকে নেওয়া, ছবিটি তুলেছেন শ্রী কল্যান কুমার।

মাধবাচার্য ছিলেন দ্বৈত দর্শনের প্রবর্তক এবং কর্ণাটকের উদুপির সঙ্গে যুক্ত। বারকরি কথার অর্থ হল এমন একজন ভক্ত, যিনি পান্ধারপুরে ভিটোবা বা বিটঠলের দর্শনের জন্য তীর্থযাত্রার স্বপ্ন দেখেন। ভিটোবা বা বিটঠল সর্বদা নিজের ভক্তদের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। ১২৭৫–১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানদেব এই ধারার সূচনা করেন। তিনি গীতার একটি সংস্কৃৃত ভাষ্য ‘জ্ঞানেশ্বরী’ রচনা করেন। তাঁর পরিবার সামাজিক প্রথাকে অস্বীকার কারণে সমাজ থেকে বহিস্কৃত হয়। ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে মহারাষ্ট্রে জ্ঞানদেবের পরে আরও অনেক বারকরি সাধুদের উত্থান ঘটে। এনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুক্তাবাই, নামদেব, জনাবাই, একনাথ এবং তুকারাম। জ্ঞানদেবের মতন এনারাও একই সঙ্গে সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যস্রষ্টা ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তাঁরা নারীদের ও নিচু জাতির মানুষদেরও আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সমস্ত রকম ভেদাভেদের উর্ধ্বে গিয়ে ওনারা সকলের সেবা করতেন । ওনারা মারাঠি ভাষায় লিখতেন এবং ওনাদের ঈশ্বর ভক্তি ছিল অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও গভীর ভাবে দার্শনিক। জনাবাই লিখেছেন, “আমি ভগবানকে খাই, ভগবানকে পান করি, আমি ভগবানের ওপরে ঘুমোই, আমি ভগবানকে কিনি, আমি ভগবানকে গুনি, আমি ভগবানের সাথে দর কষাকষি করি। শূন্যতাও ঈশ্বরশূন্য নয়।”

এই ছবিটি উইকিমিডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে – এটি শ্রী উদয়কুমার পি আর -এর তোলা বারকরি ভক্তদের বার্ষিক পান্ধারপুর যাত্রার ছবি।

১৬শ শতকে বর্তমান আহমেদাবাদে সমাজের নিম্নবর্ণে দুজন সাধু জন্মগ্রহণ করেন, যারা সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। দাদু দয়াল ব্রজভাষাতে লিখতেন। তিনি রাজস্থানে অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে দাদুপন্থীরা এখনো বাস করে। অখা ভগত আজও গুজরাটে সমানভাবে জনপ্রিয়। উনি আমেদাবাদে যেখানে থাকতেন সেই জায়গাটি আজ অখা না ওড়ো (অখার ঘর) নামে পরিচিত। জহুরি পরিবারে জন্ম নেওয়া অখাকে সাধারণত এক পাগড়ি পরা, বড় দুল পরিহিত, কঠোর অভিব্যক্তির মানুষ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ওনার ছয় লাইনের কবিতা ছপ্পা -তে (গুজরাটিতে ৬ কে ‘ছ’ বলে, তার থেকে এই নাম) ওনার চেহারার মতোই প্রতিবাদের ছবি ফুটে ওঠে। এগুলি জাতি-ভেদ, ধার্মিক ভণ্ডামি ও গরীবদের বঞ্চনা করা পুজো আচারের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করত। যেমন একটি ছপ্পাতে তিনি লেখেন-
“হরির সঙ্গে পরিচয় নেই, তবু গেরুয়া পরে বসে আছে; গুরুর বেশখানা যেন ব্যাগ থেকে বের করা কোনো ভেলকি।”

উইকিমিডিয়া থেকে নেওয়া এই ছবিতে আমেদাবাদে স্থাপিত অখা ভগতের মূর্তিটি দেখা যাচ্ছে।

কবি সুরদাস (খ্রিষ্টাব্দ ১৫শ – ১৬শ শতাব্দী) মীরাবাঈ-এর সমসাময়িক ছিলেন। এইসব সাধুদের রচনাগুলি আজও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে গাওয়া হয়। তাঁর কবিতাগুলি “সুরসাগর” নামে সংকলন এবং সংরক্ষণ করা হয়েছে। রামচরিতমানসের সৃষ্টিকর্তা তুলসীদাসের সঙ্গে একইসাথে সুরদাসকে উত্তর ভারতের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভক্তি সাধুদের মধ্যে গণ্য করা হয় | শ্রদ্ধার সূচক হিসেবে উত্তর ভারতে আজও অন্ধ ব্যক্তিদের ‘সুরদাস’ বলে সম্বোধন করা হয়। সুরদাসের ভক্তির অভিজ্ঞান পাওয়া যায় নিম্নলিখিত বাণীটিতে:
“অন্ধকার প্রভু ছাড়া সুর যেন এক বিষদংশিত, কাতর কন্যা—
বিষের যন্ত্রণায় কুঁচকে পড়ে আছে।”

ছবিটি ১৯৫২ সালে ভারতীয় ডাকবিভাগ দ্বারা কবি সুরদাসের সম্মানে প্রকাশিত ডাকটিকিট থেকে নেওয়া।

২০২২ সালে পাঞ্জাবের একটি নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রী মোদী উদ্ধৃত করেছিলেন,
“অ্য়ায়সা চাহুঁ রাজ ম্যায়, মিলে সবন কো অন্ন, ছোট বড় সব সম বসে, রবিদাস রহে প্রসন্ন”।
রবিদাস (রাইদাস) ছিলেন ১৫শ শতাব্দীর এক মহান ভক্তি সাধক। তিনি বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ভক্তি সন্তদের মধ্যে একজন অন্যতম প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সমকালীন দলিত সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি ছিলেন, যার নামে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মন্দির নির্মিত হয়েছে। তাঁর ৪০টি শ্লোক শিখদের গুরু গ্রন্থ সাহিবে স্থান পেয়েছে। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, ভক্তি সন্ত মীরাবাঈ তাঁর শিষ্যা ছিলেন। মীরাবাঈ একজন রাজকুমারী ছিলেন। হিন্দু সমাজের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পরিবার, চিতোরের রাজবংশে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর অকালমৃত্যুর পরে কৃষ্ণভক্তিতে আত্মনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে তিনি গৃহত্যাগ করেন। সম্ভবত ভ্রমণের সময়ে তিনি সন্ত রবিদাসের সংস্পর্শে আসেন। এক রাজকন্যা ও এক “অস্পৃশ্য” গুরুর এই কাহিনী থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে ভক্তিতে সামাজিক বিভাজনের কোনো স্থান নেই।
সূত্র: https://timesofindia.indiatimes.com/india/when-pm-modi-quoted-sant-ravidas-to-counter-rahul-gandhis-king-barb/articleshow/89634558.cms

উইকিমিডিয়ার এই ছবিটি একটি পাহাড়ি চিত্রকর্ম, যা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে আঁকা হয়েছিল। এতে দেখা যাচ্ছে যে ভক্ত রবিদাস একজন চর্মকার হিসেবে কাজ করছেন।

পিতা হুমায়ুনের মৃত্যুর পরে চাচা বৈরাম খানই ছিলেন আকবরের শিক্ষক এবং রিজেন্ট। এই বৈরাম খানের পুত্র ছিলেন আবদুর রহিম খান-এ-খানান (১৫৫৬-১৬২৭) । রহিম খান আকবরের সঙ্গে বিভিন্ন সামরিক অভিযান বিশেষত গুজরাট অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি পরে মীর আরদ পদে অধিষ্ঠিত হন—এই পদে তিনি সম্রাটের উদ্দেশ্যে আসা হাজার হাজার দরখাস্ত শোনার দায়িত্ব পালন করতেন। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল—তিনি হলেন সেই ‘রহিম দাস’, যাঁর নাম আমাদের স্কুলের হিন্দি পাঠ্যবইয়ে মধ্যযুগের আরও তিন বিখ্যাত ভক্তি কবি সুরদাস, তুলসীদাস ও কবীর-এর সঙ্গে একই ছত্রে লেখা থাকত। তিনি জীবনযাপন সম্পর্কে ‘নুসখা’ বা জীবনপদ্ধতি সম্পর্কে উপদেশমূলক দোহা রচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ,
“রহিমন ধাগা প্রেম কা, মত তোড়ো চটকায়, টুটে সে ফির না জুড়ে, জুড়ে গাঁঠ পর যায়।”
[ভালোবাসার সুতোটিকে কখনো টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলো না। ছিঁড়ে গেলে আবার জোড়া লাগালেও, সেখানে একটা গিঁট রয়ে যায়।]
তাঁর মতোই, আরও কিছু প্রখ্যাত মুসলিম ভক্তি কবি ছিলেন—যেমন রসখান, যিনি শ্রীকৃষ্ণ ভক্তির জন্য প্রসিদ্ধ, এবং আবদুর রহিম, যিনি পাঞ্জাবি ভাষায় রচনা করতেন।
https://scroll.in/article/814998/meet-abdur-rahim-khan-e-khanan-who-was-also-the-bhakta-poet-rahim-das.

উইকিমিডিয়ার থেকে নেওয়া ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, পিতার মৃত্যুর পর কিশোর রহিমকে আকবরের হাতে সমর্পণ করা হচ্ছে।

বাউল শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ভাতুল’ থেকে, যার অর্থ – “পাগল”। এই পাগলামি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা উপেক্ষার প্রতীক। বাউলরা সাধারণত শ্রমজীবী জাতিগোষ্ঠীর লোক, যারা ছোট ছোট সম্প্রদায়ে বসবাস করেন এবং একজন গুরুকে কেন্দ্র করে তাদের জীবন আবর্তিত হয়। আধ্যাত্মিক উন্নতি, প্রেম ও জীবনের আনন্দ উপভোগ করাই তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য়। তাঁদের রচনা করা দার্শনিক গানগুলি কিছুটা ধাঁধার মতো, যেগুলোর অর্থ সহজে বোঝা যায় না। যদিও রাস্তার ধারে গান গাওয়া বা ‘স্ট্রিট পারফরম্যান্স বাউলদের আদি রীতি নয়, তবে এটি ই এখন ওনাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায় এবং এর মাধ্যমেই তাঁরা পরিচিতি পান। অমর্ত্য সেনের ঠাকুরদাদা ক্ষিতিমোহন সেন বাউল সম্প্রদায়ের উপর যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। তাঁর কথায়: “তাঁরা (বাউলরা) বলেন, এই সব ধর্মগ্রন্থ তো প্রাচীন ভোজের উচ্ছিষ্ট। আমরা কি কুকুর? – যে এসব চেটে খেতে যাব? দরকার হলে আমরা নতুন বানাব।” এইরকম শক্তিশালী ভাষা প্রচলিত ধর্মীয় মান্যতার প্রতি এক সাহসী প্রতিবাদ।

উইকিমিডিয়ার ছবিটি ২০২২ সালের একটি বাউল শোভাযাত্রার ছবি, আপলোড করেছেন কন্ট্য়াক্ট বেস (পশ্চিমবঙ্গ)।

১৩৯৮ সালে বারাণসীতে এক মুসলিম তাঁতির পরিবারে কবীর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রামানন্দ নামক এক বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধুর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁকেই গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপরে তিনি রামের ভক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর সহজ ভাষায় লেখা দোহা আজও উত্তর ভারতে প্রতিদিনের কথোপকথনে ব্যবহৃত হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তাঁকে নিজেদের বলে দাবি করে এবং তাঁকে দাহ করা হবে না কবরে সমাহিত করা হবে তা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
জনশ্রুতি অনুসারে, কবীর এই বিতর্কের পূর্বাভাস আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন – যদিও গল্পটির বাস্তবিকতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে । তিনি লিখেছেন, “তুমি মারা গেলে তোমার দেহ নিয়ে কী করা হবে? হিন্দুরা পোড়াবে, তুর্কিরা কবর দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে এই সংসার ছাড়তে হয়। মৃত্যু তো কর্মের জাল বিছিয়ে রাখে, ঠিক যেমনভাবে জেলের জালে মাছ ধরা পড়ে। রাম ছাড়া মানুষের কী অস্তিত্ব আছে? যখন এ ঘর ছেড়ে ও ঘরে যাবে, তখন ভুল বুঝতে পেরে আফশোষ করবে।”

ছবিটি ১৯৫২ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ কর্তৃক কবীরের সম্মানে প্রকাশিত একটি ডাকটিকিটের ছবি।

১৮৭৫ সালে কলকাতার সাহিত্যজগতে বৈষ্ণব কবি ভানুসিংহ-এর লেখা একগুচ্ছ কবিতার আবির্ভাব ঘটে। একটি দুর্লভ বাংলা উপভাষা ব্রজবুলি-তে রচিত এই কবিতাগুলি ছিল সত্যিই অনন্য। পরে জানা যায়, ঠাকুর পরিবারের (যাঁদের সংস্কারপন্থী মনোভাব সর্বজনবিদিত) এক তরুণ সদস্য এই কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন। এই কবিতাগুলিতে পূর্ব ভারতের আবেগময় ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১২শ শতকে জয়দেব তাঁর গীতগোবিন্দ কাব্যের মাধ্যমে এই ভক্তি ধারার সূচনা করেছিলেন। পরে চৈতন্য মহাপ্রভু, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, রামপ্রসাদ সেন প্রমুখ এই ধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেন। এই কবিরা ১৫শ শতক থেকে সংস্কৃত ত্যাগ করে বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা শুরু করেন। তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শুধুমাত্র ভক্তি নয়, আছে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের স্বরও। যেমন — “আর কতকাল আমি বৃক্ষের ছায়াতলে গোপনে অপেক্ষা করব? কখন সে তাঁর বাঁশির সুরে দীর্ঘ স্বরে আমার নাম ডেকে উঠবে?”

উইকিমিডিয়ার চিত্রটি উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের ওড়িশা রাজ্য সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত জয়দেবের গীতগোবিন্দ-এর মূল পাণ্ডুলিপি (তাল পাতায় লেখা) থেকে নেওয়া।