বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর জন্মসন ১৮৩৮। ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করে দীর্ঘ ত্রিশ বছর বাংলায় ব্রিটিশ প্রশাসনে তিনি কর্মরত ছিলেন। এই সময়সীমায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাংলা উপন্যাস রচনা করেন যেগুলির মধ্যে ব্রিটিশ-রাজের বিরোধিতা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পায়। তাঁর লেখা আনন্দমঠ উপন্যাসের ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীকালে জাতীয় সংগীতের সমতুল্য মর্যাদা পেয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতের জাতীয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তী জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র ভারতের ঐতিহ্য বিষয়ক অনেক গবেষণামূলক রচনা লিখেছিলেন। পরিহাসচ্ছলে উল্লেখ্য যে স্নাতক পরীক্ষায় বাংলা ভাষার পাশ করার জন্য তাঁর গ্রেস নম্বরের প্রয়োজন হয়েছিল।
শ্রীকৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে তিনি ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন “কৃষ্ণের মানবিক দিক নিয়ে পর্যালোচনা করার” জন্য। তিনি লিখেছিলেন, “আমার ঈশ্বরের কল্পকাহিনীর আড়ালে যে বিষয়টি লুকিয়ে আছে তা পবিত্র; কৃষ্ণের ন্যায় আদর্শ চরিত্র মানব ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই।” ‘ইতিহাসের কৃষ্ণ’কে কল্পনার অন্তরাল থেকে উদ্ধারের যে পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেছিলেন, তা ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
উৎস: “কৃষ্ণ চরিত্র,” অনুবাদ: আলো সোম
ছবি: https://www.goodreads.com/book/show/68590649

১৮৭২ সালে অরবিন্দ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায় এবং ইংল্যান্ডে শিক্ষালাভ করেন। পুরোমাত্রায় পাশ্চাত্যশিক্ষা প্রাপ্ত অরবিন্দ আপন শিকড়ের সন্ধানে ভারতে ফিরে আসেন এবং ভারতের দেশীয় রাজ্যতন্ত্র বরোদায় কর্মে যোগদান করেন। সেখানেই তিনি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেন।। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের পর তিনি চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রথম সারির নেতা হয়ে ওঠেন। সেই সময় একাধিকবার পরাধীন ভারতের দণ্ডবিধি অনুযায়ী তিনি অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ হন। এই কঠোর কারাজীবন তাঁকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়।
উত্তরপাড়ায় জয়কৃষ্ণ পাঠাগারে অনুষ্ঠিত একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, “যে কারাগার আমাকে জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, তার দিকে তাকিয়ে কিন্তু বন্দীশালার উঁচু দেওয়াল দেখতে পেতাম না; দেখতাম বাসুদেব আমায় ঘিরে রেখেছেন।”
১৯১০ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং পণ্ডিচেরিতে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত করেন।
গীতা বিষয়ক তাঁর লেখাগুলি ‘তাত্ত্বিক, অধিবিদ্যক বা বিশ্লেষণধর্মী’ ছিল না। তিনি লিখেছিলেন, “আমরা গীতার কাছে সাহায্য ও আলোর সন্ধানে যাই। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এর অন্তর্নিহিত ও জীবনভিত্তিক বার্তাকে চিহ্নিত করা — সেই বার্তাকে, যা মানবজাতিকে তার সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
সূত্র: শ্রী অরবিন্দ: কারা কাহিনী, গীতার উপর প্রবন্ধ

মহাত্মা গান্ধী ভগবদগীতার প্রতিটি শ্লোকের ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিনব: “গীতা কোনও ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়। এটি ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধের নয়, মানব হৃদয়ের শুভ ও অশুভ প্রবৃত্তির সংঘাতের বর্ণনা। গীতার যত গভীরে যাওয়া যায়, ততই তার অর্থ সমৃদ্ধ হয়।”
তিনি পরামর্শ দেন যে কোনো মানসিক দ্বিধায় আমাদের আপন বিবেকের কণ্ঠস্বর শোনা উচিত। তিনি এই কণ্ঠস্বরকে কৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন: “আমাদের দেহ একটি যুদ্ধক্ষেত্র। কৃষ্ণ প্রত্যেকের হৃদয়ে বাস করেন এবং ঘড়ির কাঁটার মত নিরন্তর তাঁর বার্তা গুঞ্জন করে যান। কিন্তু ঠিক যেমন ঘড়িকে প্রতিনিয়ত চাবি দিতে হয় তেমনি চিত্তকে আত্মচেতনার দ্বারা পরিশুদ্ধ রাখতে হয়, নচেৎ সেই অন্তর্বাসী ঈশ্বর স্বস্থানে থাকলেও, তাঁর সেই অবিরাম বার্তা আর শোনা যায় না।”
সূত্র: এম. কে. গান্ধী, দ্য ভাগবদগীতা

চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, যিনি ‘রাজাজী’ নামে সমাদৃত, ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অগ্রদূত। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ, ভারত প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হওয়া পর্যন্ত, তিনি ভারত অধিরাজ্যের দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিশিষ্ট বিরোধী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
রামায়ণ, মহাভারত ও গীতার অত্যন্ত জনপ্রিয় সহজ ইংরেজি সংস্করণের রচয়িতা হিসাবে রাজাজী বিখ্যাত হয়েছিলেন। যুবসমাজকে তাঁর গীতা কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, সে বিষয়ে রাজাজী লেখেন:
“প্রধানত ছাত্রদের জন্য রচিত এই সারাংশটি সেই পুরাণের গল্পের পিতার মত। সেই পিতা তাঁর সন্তানদের বলেছিলেন তাদের নিজেদের জমিতে গুপ্তধন প্রোথিত আছে, তা সন্ধানের জন্য খনন করতে হবে। সোনার খোঁজ মিলেছিল ঠিকই, তবে তা কোনও হাঁড়িতে লুকিয়ে থাকা ধনরত্ন নয়, কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার হিসেবে আশাতীত শস্য ফলন হিসেবে। তেমনই, লেখকের গীতার ব্যাখ্যায় বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু যদি পাঠকরা খনন করতে উৎসাহিত হন, তবে গীতা — আমাদের অমূল্য ঐতিহ্য — সাধনাপ্রবণ আত্মাকে এক সমৃদ্ধ ফলন দেবে।”
চিত্র: https://www.goodreads.com/book/show/35049196-the-bagavad-gita

লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন। “স্বরাজ্য আমার জন্মগত অধিকার” — এই বিখ্যাত স্লোগানের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করেন। বেদ ও তার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে তিনি বহু গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন।
মারাঠি ভাষায় তাঁর রচিত গীতা রহস্য গ্রন্থটিতে তিনি ত্যাগ বা ভক্তির চেয়ে কর্মের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি লিখেছেন: “আমি শুরুতেই বলতে চাই, কী কারণে আমি শ্রীমদভগবদগীতার অধ্যয়নে আগ্রহী হলাম। যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রায়শই আমার বয়োজ্যেষ্ঠরা বলতেন যে প্রকৃতরূপে ধার্মিক এবং দার্শনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপনের কোন সামঞ্জস্য নেই, এবং একই সঙ্গে পৃথিবী ও ঈশ্বর — এই দুই প্রভুর সেবা করা যায় না। তাই আমি নিজের মধ্যেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলাম — আমার ধর্ম কি দাবি করে যে মানবজীবনে পূর্ণতা লাভের প্রচেষ্টা শুরু করবার আগেই আমি এই সংসার পরিত্যাগ করি?”
উৎস: https://culturalsamvaad.com/bal-gangadhar-tilak-on-the-gita-rahasya/

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব অনুসরণ না করে লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল (লাল-বাল-পাল) সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষপাতি ছিলেন। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের আগমনের প্রতিবাদে লাঠিচার্জে আহত হয়ে লাজপত রায়ের মৃত্যু হয়। এটি স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
লাজপত রায় উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তাঁর জন্মভূমি পাঞ্জাবে অহিন্দুরা কৃষ্ণের জীবনের প্রগলভ বিশ্লেষণ করলে সেটি ধর্মীয় অশান্তির কারণ হতে পারে। জনমনে ভুল ধারণা দূর করার জন্য তিনি উর্দু ভাষায় ‘যোগীরাজ কৃষ্ণ’ নামক গ্রন্থ রচনা করে কৃষ্ণের জীবন ও কর্মের উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও বিস্মৃত এক রহস্যময় মানুষ ছিলেন হসরত মোহানী। তিনি সম্ভবতঃ ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটির উদ্ভাবন করেন। তিনি ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং ‘মৌলানা’ উপাধিপ্রাপ্ত এক সুফি মুসলিম বিদ্বজ্জন। ভারতের সংবিধানসভায় মুসলিম লীগের সদস্য হিসাবে তিনি জিন্নাহর নির্দেশের বিরোধিতা করে পরিষদ বর্জন মানতে অস্বীকার করেন এবং ভারত-পাকিস্তান বিভাজন নীতি প্রত্যাখ্যান করেন।
গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের ভক্ত কবিদের ধারা অনুসরণ করে, উর্দু ও আওধি মিশ্রণে তৈরি ‘ভাষা’য় তিনি কৃষ্ণ ভক্তিমূলক কবিতা রচনা করেন। এই কাব্যধারার সূচনা করেন মুঘল দরবারের কবি এবং আকবরের নবরত্ন সদস্য আব্দুর রহিম খান-ই-খানান ওরফে রহিম।
মোহানী লিখেছেন: “কুছ হাম কো ভী ‘আতা হো কি আই হযরত-এ-কৃষ্ণ, ইকলীম-এ-ইশ্‌ক আপ কে জের-এ-কদম হ্যায় খাস, হসরত কি ভী কবুল হো মথুরা মেঁ হাজিরী, শুনতে হ্যায় ‘আশিকোঁ পে তুমহারা করম হ্যায় খাস।” অর্থাৎ — “ কিছু আমাকেও দান করুন, হে হযরত-কৃষ্ণ, আপনার পদতলে লুটিয়ে রয়েছে প্রেমের সমগ্র রাজ্য, মথুরায় হসরতের উপস্থিতি গ্রহণ করুন, শুনেছি, প্রেমিকদের প্রতি আপনার বিশেষ অনুগ্রহ আছে।ʼ
উৎস: সি. এম. নঈম, দ্য মৌলানা হু লাভড কৃষ্ণ, ইপিডব্লিউ, এপ্রিল ২০১৩

রাম মনোহর লোহিয়া সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রের একটি স্বতন্ত্র ভারতীয় সংস্করণের বিকাশের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজজীবনের অর্থনৈতিক, ও জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা ভিত্তিক সর্বপ্রকার বৈষম্য এবং কঠোর রক্ষণশীলতা দূর করতে চেয়েছিলেন এবং অর্থকরী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি উত্তর ভারতের পিছিয়ে পড়া মানুষের নেতাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি কংগ্রেস দলে সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর অংশ ছিলেন। স্বাধীনতার পর এই গোষ্ঠী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে নেহরুর বিরোধী দল হিন্দ কিষাণ পঞ্চায়েত গঠন করেন।
নাস্তিক হলেও, তিনি কখনোই ঐতিহ্যের প্রভাবকে অবমাননা করেননি বা আমাদের সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ করেননি। তিনি লিখেছিলেন —“রাম, কৃষ্ণ ও শিব হলেন ভারতের তিনটি পরিপূর্ণ স্বপ্ন। রাম সীমিত ব্যক্তিত্বের এক নিখুঁত রূপ, কৃষ্ণের মধ্যে এক সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণতা এবং শিব অমাত্রিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন। প্রতিটি রূপই আপন গুণের বলয়ে সম্পুর্ণ, কেউ কারো অপেক্ষা কম নন। পূর্ণতা নির্ভর করে গুণ বিশেষের উপর। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় গুনাবলীর পূর্ণতা অর্জনের প্রয়াস করা উচিত।”
উৎস: ʼরাম, কৃষ্ণ, শিবʼ lohiatoday.com https://thebiharmail.com/bihar-state-govt-recommends-dr-ram-manohar-lohiya-and-karpoori-thakur-name-for-bharat-ratna/

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আজীবনের সঙ্গী। তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য ছিলেন। রামকৃষ্ণ বলতেন, “গীতা” শব্দটি বারবার একভাবে উচ্চারণ করলে — “গীতা, গীতা, গীতা…” — একসময় তা হয়ে যায় “তা-গী, তা-গী, তা-গী…।”
“ত্যাগ” শব্দের অর্থ হলো সবকিছু ঈশ্বরের জন্য ত্যাগ বা উতসর্গ করা বা ত্যাগী হওয়া। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, গীতা আমাদের নিঃস্বার্থ ও ত্যাগী হতে শেখায় ।
উৎস: https://vivekavani.com/swami-vivekananda-bhagavad-gita/
চিত্র – উইকিমিডিয়া

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানের ইতিহাসে সম্ভবত সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন। তাঁর মুখে ছিল হাসি, হাতে ছিল ভগবদ্‌গীতা। বিচারক যখন তাঁকে তাঁর অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি সমধুর হেসে জবাব দেন — “আপনি অনুমতি দিলে, আমি আপনাকে মুহূর্তের মধ্যে বোমা তৈরির পদ্ধতি শেখাতে পারি।”
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্যদের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ‘অনুশীলন সমিতি’-তে যোগ দেন। ১৯০২ সালে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, সতীশচন্দ্র বসু এবং প্রমথনাথ মিত্রের উদ্যোগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শে গঠিত বাংলার এই সশস্ত্র ব্রিটিশ-বিরোধী সংগঠনের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক ও অত্যাচারী ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। ১৯০৮ সালে বিহারের মুজফ্‌ফরপুরে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে হত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী (যাঁর বয়সও মাত্র ১৯) ধরা পড়েন।
উৎস: https://www.indiatoday.in/education-today/gk-current-affairs/story/khudiram-bose-life-facts-youngest-freedom-fighter-2644105-2024-12-03
চিত্র – উইকিমিডিয়া

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বিশ শতকের অন্যতম স্বীকৃত ও প্রভাবশালী ভারতীয় চিন্তাবিদ রূপে শিক্ষামহলে বেশি পরিচিত। তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে হিন্দুধর্ম দর্শনগতভাবে সুসংহত এবং নৈতিকভাবে কার্যকর একটি তত্ত্ব। পাশ্চাত্য দর্শনের উপর তাঁর বিস্তৃত জ্ঞান তাঁকে ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক সেতুবন্ধন নির্মাণ করতে সাহায্য করেছিল। রাধাকৃষ্ণন শাস্ত্রীয় আঙ্গিকে গীতার উপর ব্যাখ্যা লিখেছিলেন, তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক।
তিনি লিখেছিলেন —“আমাদের যুগ আলাদা; আমাদের অভ্যস্ত চিন্তাভাবনা, যে মানসিক প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে বিচার করি, তা শাস্ত্রীয় ভাষ্যকারদের থেকে আলাদা। আজ আমাদের প্রধান সমস্যা হল মানবজাতির সমন্বয়সাধন। গীতা এই উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে কার্যকরী, কারণ এটি ধর্মচেতনার বিবিধ ও আপাতবিরোধী রূপগুলির সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করে।”
ছবি: স্বরাজ্য পত্রিকা থেকে, যেখানে রাধাকৃষ্ণন রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে — ভারতের দুইজন দিকপাল আধুনিক দার্শনিক।
ছবি: স্বরাজ্য পত্রিকা থেকে, যেখানে রাধাকৃষ্ণন রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে — ভারতের দুইজন দিকপাল আধুনিক দার্শনিক।

ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক অ্যানি বেসান্ত (১৮৪৭–১৯৩৩) ছিলেন সমাজতন্ত্র, জন্মনিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক সংঘ এবং নারীর অধিকারের ওজস্বী সমর্থক। তিনি থিওসফিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, হোম রুল লীগের প্রতিষ্ঠাত্রী ছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি ছিলেন। দুটি অনুবাদ ও দুটি ভাষণমালার মাধ্যমে অ্যানি বেসান্ত গীতার সারাংশ অন্বেষণ করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের পরিভাষা দিয়ে তিনি গীতার সেই গভীর বাণীর অনুসন্ধান করেন, যা উন্মোচিত করা প্রয়োজন।
বেসান্ত যোগধর্মকে সুনির্দিষ্ট কোনো দার্শনিক বা ধর্মীয় প্রথার পরিবর্তে একটি সার্বজনীন আত্মিক উন্নয়নের পদ্ধতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ভাষায় গীতা একটি “যোগশাস্ত্রের গ্রন্থ, ঐশিক প্রজ্ঞার সাথে একাত্মতা, এবং পরমাত্মা ও আপন চেতনার শুভমিলন।” কুরুক্ষেত্র তাঁর দৃষ্টিতে “আত্মার সংগ্রামভূমি”, অর্জুন “যোদ্ধৃ আত্মা” এবং কৃষ্ণ “আত্মার যুক্তি ও দর্শনের বোধ”। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল ʼকাঙ্ক্ষী আত্মা” – যাদের পথ ভিন্ন কিন্তু লক্ষ্য এক – তাঁদের জন্য গীতা একটি আবশ্যিক পাঠ।
উৎস: অ্যাঞ্জেলিকা মালিনার, দ্য গ্রেট আনভেইলিং: অ্যানি বেসান্ত অ্যান্ড দ্য ভাগবদ গীতা, জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়